আজব সামাজিকতা
আমার একটা অভ্যাস হলো, আমি হাঁটতে পারলে সাধারণত গাড়িতে উঠি না। আর যদি রোদের মধ্যে হাঁটতে কোন সমস্যা না হয়, তাহলে রোদের মধ্য দিয়েই চলাফেরা করি, ছায়া থাকলেও সেখানে যাই না। এটা আমার সব সময়ের অভ্যাস; যখন যেখানেই থাকি, এভাবেই চলাফেরা করি।
গতকালের কথা। খুব কড়া রোদের মধ্যে হাঁটছিলাম। গরম বেশি হওয়ার কারণে টাইটা খুলে বগলে চেপে রেখেছি। এমন সময় আমার এক পরিচিত ব্যক্তিকে আসতে দেখলাম। তার সাথে আমার মোটামুটি ভালই সম্পর্ক। তবে তার একটা বিষয় হলো, তিনি তার কিছু অভ্যাসকে এত গুরুত্বের সাথে মেনে চলেন যেন বিরাট ফযীলতের কোন এবাদত করছেন। আর অতিরিক্ত রকমের সামাজিক। মানে লোকে কি বলবে, এ ব্যাপারে খুব বেশি রকমের সাবধানী।
তো কাছাকাছি আসতে সালাম দিয়েই চোখমুখ কুচকে বলে উঠলেন, আপনি এগুলো কি করেন!
আমি একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, আমি আবার কী করলাম?
মনে মনে ভাবছি, না জানি কি করেছি! অজান্তে কি আমার দ্বারা কোন বিদআত চালু হয়েছে? নাকি অন্য কোন ধরণের অপরাধ করে ফেললাম? নাহ, তেমন কিছু তো মনে পড়ছে না। তাকে বললাম, দেখুন ভাই, কি হয়েছে খুলে বলেন। কী শুনেছেন আমার নামে। যা শুনেছেন সেটা ভুল বা মিথ্যাও হতে পারে।
তিনি বললেন, কারো কাছ থেকে কিছু শুনিনি, নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী দেখতে পাচ্ছেন?
আপনি যে টাই ছাড়া হাঁটছেন, মানুষ কি বলবে বলুন তো! আপনি সুপ্রিমকোর্টের একজন সম্মানিত উপদেষ্টা। আপনাকে এভাবে হাঁটা মানায়?
তখন আমি আর তার সাথে কথা বাড়ালাম না, সামনের দিকে হাঁটা ধরলাম। ভাবলাম, নগরের সভ্যতাগুলো বুঝি শুধুই লৌকিকতা!
গরু-ছাগল বাধার দড়ির মত আমরা আমাদের গলায় টাইয়ের গিঁট দিয়ে রাখি। গরমের মধ্যে শ্বাস বন্ধ হবার জোগাড় হয় এই জিনিসের কারণে। কিন্তু এটা খোলার কোন উপায় নেই। কেন? ভদ্রতা, মানুষ কি বলবে, এই সব।
মেয়েরা হাইহিল নামের বিদঘুটে এক ধরণের জুতা পরে। অথচ এই জুতা পরে হাঁটার চেয়ে পাহাড় বেয়ে ওঠা অনেক সহজ। ছেলেদের কারো যদি আমার কথা বিশ্বাস না হয়, তাহলে পায়ের আঙ্গুলে ভর দিয়ে হাঁটতে চেষ্টা করে দেখুন কেমন লাগে। আর এই জিনিস পরে হাঁটাহাঁটির কারণে মেয়েদের পায়ের গোছা হয়ে যায় শক্ত। যা পায়ের স্বাভাবিক সৌন্দর্য ও আকর্ষণ নষ্ট করে ফেলে।
এমন না যে এই বিদঘুটে জুতা পরিধান করার মধ্যে নারী জাতির বিরাট কোন কল্যাণ নিহিত। অথবা বিরাট কোন সৌন্দর্যের গোপন রহস্যের চাবিকাঠি আছে এই জুতায়। তেমন কিছুই না। তাহলে কেন এত কষ্ট করে হাঁটতে হবে এগুলো নিয়ে?
কারণ এটাই ফ্যাশন। এটা না পরলে মানুষ কি বলবে!
একবার ট্রামে চড়ে কোথাও যাচ্ছিলাম। যাত্রীরা সবাই বসে আছে। তারপরও বেশ কিছু আসন খালি রয়ে গেছে। এক ভদ্র মহিলা দেখলাম দাঁড়িয়ে আছেন। ট্রামের অনেকগুলো আসন খালি। কিন্তু তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। কেউ তাকে বসতে অনুরোধ করলে মানা করে দিচ্ছেন। প্রথমে বুঝতে পারিনি, কিন্তু একটু ভাল করে লক্ষ্য করেই বুঝলাম আসল ঘটনা কি।
ব্যাপারটা হলো, ঐ মহিলা এমন আজিব কিসিমের এক টাইট পোশাক পরে আছে, যেটা পরে ঠিকভাবে হাঁটাই সম্ভব না। কয়েদীদের লোহার বেড়ি পরানো হলে তাদের যে অবস্থা হয়, ঐ মহিলার ঠিক একই অবস্থা। এসব পোশাক পরে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গেলে পায়ের প্রায় পুরোটাই উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। তাই এ অবস্থায় কোথাও বসা তার পক্ষে সম্ভব না। পাঠক হয়ত মনে মনে ভাবছেন যে, সে নিজেকে নিজে এত কষ্ট কেন দিচ্ছে?
উত্তর হলো, এই মহান আত্মত্যাগ সে করছে ফ্যাশনের খাতিরে। কয়েদী না হয়েও কয়েদীদের মত চলাফেরা করাটাই ফ্যাশন। এটা না করলে লোকে কি বলবে!
উঠতি বয়সের কিছু যুবক আছে, যারা চুল আচড়ানোর মত একটা সাধারণ বিষয়কে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যায়। এমন নিপুণ নকশা তাদের মাথায় দেখা যায়, কমপক্ষে আধঘন্টা এর জন্য আয়নার সামনে ব্যয় না করলে এটা কখনই সম্ভব হওয়ার কথা না। আর তারপর সারাদিন এই দুশ্চিন্তায় অস্থির থাকে যে, বাতাসে অথবা কারো হাত লেগে এই শৈল্পিক নকশায় কোন খুঁত না সৃষ্টি হয়ে যায়। মাথায় হয়ত উকুন কামড়াচ্ছে বা খুশকির কারণে মাথা চুলকাচ্ছে, সারাদিন এই কষ্ট বয়ে বেড়াবে। কিন্তু ভুলেও মাথায় হাত দেবে না। কেন? এত কষ্ট কীসের জন্য? উত্তর হলো, ফ্যাশনের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য। ফ্যাশন যদি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে লোকে কি বলবে!
মেয়েদের সব ধরণের কোমল ও নম্র ব্যবহার বাইরের মানুষদের জন্য বরাদ্দ। উন্নত রুচি, শান্ত কোমল কণ্ঠস্বর, মুচকি হাসি, উচ্ছসিত চেহারা- এ সবই অতিথি ও বন্ধুবান্ধবদের জন্য। এগুলো তদের সামাজিকতা রক্ষার হাতিয়ার। আর স্বামীর জন্য? স্বামীর জন্য হলো ভাবাবেগহীন যান্ত্রিক কথাবার্তা এবং বিরক্তি মেশানো ভ্রু কুচকানো চাহনি।
তাদের সাজ-সজ্জা-সৌন্দর্য এ সবও বাইরের মানুষের জন্য। বাইরে বের হবার আগে যত সাজ-গোজের বাহার আর পারফিউম মাখামাখি। কিন্তু স্বামীর সামনে? স্বামীর সামনে চুল থাকে এলোমেলো উষ্কখুষ্ক। চেহারার ভাব হয়ে থাকে যুদ্ধের মানচিত্রের মত। শরীর থেকে অনবরত মসলা, পেঁয়াজ, রসুন এসবের দুর্গন্ধ বের হতে থাকে। দুর্গন্ধ তার আগেই তার স্বামীর কাছে পৌঁছে যায়। আর স্বামী যে মানুষটি, তিনি যে একেবারে ধোয়া কচুপাতার মত নিষ্পাপ, তা কিন্তু না। সেও স্ত্রীর সাথে এমন আচরণই করে থাকে।
বাড়িতে ডাইনিংরুম আছে, ডাইনিংটেবিল আছে। কিন্তু এগুলো হলো শুধু বাইরের মানুষের জন্য, মেহমানদের জন্য। মেহমান এলে তাদের জন্য টেবিল সাজানো হবে, আলাদা প্লেট-বাটি নামানো হবে। পুরো ডাইনিংরুমটাকে সাজানো হবে। কিন্তু যদি মেহমান না থাকে, তাহলে খাওয়া-দাওয়ার পুরো ব্যাপারটা হবে রান্নাঘরে!
মেহমানের বিশ্রামের জন্য আলাদা কামরা। সে কামরার সব কিছু পরিপাটি। দামি কাপড়ে নকশাদার সেলাই করা চাদর, বালিশের কভার। কিন্তু নিজেরা যেখানে থাকছে, সেখানে বিছানা ও বালিশের কোন বালাই নেই। না আছে লেপ তোশকের কভার, না আছে বালিশের কভার। সবই মেহমানের জন্য।
এই লোকদেখানো সামাজিকতার কারণে আমরা নিজেরাই আমাদের হাত-পা বেধে রেখেছি অর্থহীন কিছু নিয়মকানুনের বেড়াজালে।
মেয়ের বিয়ে দেয়ার সময় তার কল্যাণ, তার দাম্পত্য জীবনের সুখ-শান্তি নিয়ে আমরা ততটা চিন্তা করি না, যতটা চিন্তা ও দুশ্চিন্তা এবং কল্পনা ও পরিকল্পনা করি তার বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে। কারণ বিয়ের অনুষ্ঠানে যদি কোন কমতি হয়, তাহলে মানুষ কি বলবে!
ছেলে দেখার সময় তার চরিত্র ও ধর্মীয় সচেতনতা সম্পর্কে খুব কমই খোঁজ-খবর নেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে টপ প্রায়োরিটি পায় মোহরের বিষয়টি। কত লাখ কত টাকা কত পয়সায় মোহর ধার্য করা হয়েছে, এটার উপর নির্ভর করে বিয়ের আনুষ্ঠানিক সাফল্য। মুসলমানদের সমাজে বিয়ের মোহর এখন আর ধর্মীয় কোন বিধান নয়। এটা এখন এক ধরণের সোস্যাল স্ট্যাটাস।
বর্তমানের বিয়ে-শাদির ব্যাপারে টপ প্রায়োরিটির দ্বিতীয় স্থানে আছে বিয়ের অনুষ্ঠান। যে বিয়ের অনুষ্ঠান যত বড় ও ব্যয়বহুল, সে বিয়ে সামাজিকভাবে তত বেশি সফল। বিয়ে মূলত একটাই। কিন্তু আয়োজন দেখে লোকে বলবে- আরিব্বাপ রে! বিশাল বিয়ে, বিরাট আয়োজন! বিয়ের সাথে বিশাল শব্দটা যুক্ত হয়ে দর্শকের চোখ কপাল ছাড়িয়ে আরও উপরে উঠে যাওয়া- এটাই মূলত সামাজিক সাফল্য।
তারপর আসে বিয়ের পোশাক। মাত্র একদিন গায়ে দেয়ার জন্য বানানো হয় এই পোশাকটি। অথচ কি বিপুল অর্থই না খরচ করা হয় এর জন্য! যার যার সাধ্য অনুযায়ী শয়তানের সন্তুষ্টি অর্জনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় এ সব ক্ষেত্রে।
(আর আধুনিক যৌতুকের কথা তো বলাই হয়নি। ছেলে পক্ষ এমন একটা ভাব ধরে থাকে, যেটার তরজমা হলো- আমরা যৌতুক নেই না। কিন্তু মেয়ের খুশির জন্য যদি কিছু দিতে চান, তাহলে আমাদের কোন আপত্তি নাই। এটা হলো তরজমা। কিন্তু এর মূলে কাজ করে যৌতুকের সেই প্রাচীন ও কুৎসিত লালসা।)
তো এই যে এত এত আয়োজন-বিসর্জন, এগুলো কীসের জন্য? নবদম্পতির সুখের জন্য? কক্ষণ না। সওয়াব বা জান্নাতের আশায়? তাও না। এগুলো হলো সেই মহান সামাজিকতা রক্ষা করা জন্য, যেটা না থাকলে আমরা আশঙ্কা করি- লোকে কি বলবে!
কিন্তু এত কিছু করেও কি এই তথাকথিত সমাজ বা মানুষের মন জয় করা যায়? যত ব্যয় ও অপব্যয় করা হোক না কেন, কিছু মানুষ তো অবশ্যই বলে ফেলবে, এটা আর এমন কি। অমুকের সাথে তমুকের যখন বিয়ে হয়েছিল, সে অনুষ্ঠানে এর কয়েকগুণ বেশি খরচ হয়েছিল। এরচেও কয়েকগুণ বড় আয়োজন হয়েছিল। সেই বিয়ের মোহর ছিল এত লাখ অত টাকা তত পয়সা ইত্যাদি ইত্যাদি।
কেউ মারা গেছে। তার জন্য শোক-সভার আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু এই অদৃশ্য ও অদ্ভুত সামাজিকতার কারণে শোকসভার মত অনুষ্ঠানগুলোতেও আজকাল একটা বিনোদনের আবহাওয়া বিরাজ করে। মানে সম্পদের অপব্যয় করার ব্যাপারে কে কাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে, তারই প্রতিযোগিতা। আর তার চেয়েও অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সম্পদ অপব্যয়ের এই প্রতিযোগিতাই আজকাল সামাজিকতার উপাধী লাভ করেছে।
বিয়ে-শাদি হোক বা শোকসভা, ব্যাপারটা যদি সংশ্লিষ্ট পরিবারটির কাছের মানুষ ও নিকটাত্মীয়দের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকতো, তাহলেই যথেষ্ট হতো। কিন্তু না, ঐ পরিবারের সাথে সংশ্লিষ্ট আরো ত্রিশ/পঁয়ত্রিশটা পরিবারের আনুষ্ঠানিক অংশগ্রহণ না হলে আমাদের সামাজিকতা রক্ষা হয় না। সাধ এবং সাধ্য থাক বা না থাক, সামাজিকতা রক্ষা করতেই হবে।
কোন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী হয়ত স্বামী। সে বেচারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাজ করে যায়। বেতন খুব বেশি হলে দশ হাজার। এক একটা পয়সা আলাদা আলাদা হিসাব করে পুরো মাসের বাজেট ও খরচের পরিকল্পনা সে তৈরি করে, যাতে পরিবারের সবগুলো প্রয়োজনীয় চাহিদা পুরোপুরি না মিটলেও, অন্তুত ভারসাম্যপূর্ণ চাহিদা পূরণ যেন সম্ভব হয়।
এই যখন অবস্থা, এর মধ্যে হঠাৎ তার স্ত্রীর মামীর খালা-শাশুড়ি মারা গেলেন। তখন কোন ধরণের বিপদ সংকেত ছাড়াই তৎক্ষণাৎ তার স্ত্রী হাজির হয়ে যাবে দুই হাজার টাকার বায়না নিয়ে। ঘটনা কী? স্ত্রীর উত্তর- আমার মামীর খালা-শাশুড়ি মারা গেছে। তার শোকসভায় যাওয়ার জন্য কালো কাপড় কিনতে হবে।
স্বামী যদি বলে যে, এটা বাজেটের বাইরে, তাহলে শুরু হয়ে যাবে মুখ ফোলানো ঠোঁট ফোলানো আর রাজ্যের আহাজারি- কত ভাল একজন মানুষ ছিলেন আমার মামীর খালা-শাশুড়ি। এই বয়সে হঠাৎ মারা গেলেন। তার শোকসভায় আমি কালো কাপড় ছাড়া যাব! মানুষ কি বলবে আমার সম্পর্কে!
যার কথা বলা হচ্ছে এই বয়সে হঠাৎ করে, মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল সত্তরেরও উপরে। সুতরাং আর যাই হোক এটাকে হঠাৎ করে বলা চলে না। আর কমপক্ষে ছয় বছর যাবত তার সাথে দেখা সাক্ষাতের কোন চিন্তা নেই। এখন তার মৃত্যুতে কালো কাপড়টা জরুরী হয়ে পড়েছে।
কিন্তু এসব কথায় কে কান দেয়! সামাজিকতা বলে কথা! শোকসভার সামাজিকতা হলো কালো কাপড়ের মধ্যে। সুতরাং কালো কাপড় পরে না গেলে লোকে কি বলবে!
আপনার বসের বন্ধুর ছেলের সন্তান হয়েছে। সুতরাং সবার মত আপনাকেও একটা গিফট দিতে হবে, যার দাম আপনার বেতনের খুবই স্পর্শকাতর একটি অংশ দিয়ে চুকাতে হবে। কিন্তু এইটুকু সামাজিকতা যদি আপনি রক্ষা করতে না পারেন, তাহলে লোকে কি বলবে আপনার সম্পর্কে!
আপনি শিক্ষকতা করেন। আজকের লেকচারটা তৈরি করছেন। অথবা আপনি ব্যবসায়ী, গুরুত্বপূর্ণ কোন হিসাব করছেন। এমন সময় একজন এমবিবিএস এলেন আপনার সাথে আড্ডা দিতে। এমবিবিএস হলো, মা-বাবার বেকার সন্তান। কোন কাজ না করেই সে অবসর জীবন যাপন করছে। সে আপনার এই চরম ব্যস্ততার মুহূর্তে এলো আপনার সাথে খেজুরে আলাপ করতে। সাবধান! ভুলেও তাকে বলবেন না যে, আমি ব্যস্ত আছি। পরে আসুন। কারণ ঐ একটাই, সামাজিকতা। আপনি আপনার কাজ ফেলে তার সাথে কিছুক্ষণ খাজুরে আলাপ করতে পারলে আপনার সামাজিকতা রক্ষা পাবে। অন্যথায় আপনার সামাজিকতার অকাল মৃত্যু হবে। আর আপনি হবেন অসামাজিক!
আপনার প্রতিবেশী ভদ্রলোক অথবা আপনার কোন আত্মীয় হয়ত বিরাট বড়লোক। আর আপনি মাস শেষের বেতনটা দিয়ে সংসার নিয়ে কোন রকম জীবনটা ধারণ করে আছেন। এখন ঐ ধনী লোক যদি তার বাড়ির জন্য ঝাড়বাতি, এয়ারকুলার, ওয়াশিংমেশিন, ইলেক্ট্রিক ওভেনসহ এ ধরণের আরও দামি দামি জিনিস কেনে, তাহলে কি সামাজিকতা রক্ষা করতে আপনাকেও এ সব কিনতে হবে? আপনার তো সেই সামর্থ নেই। তো এখন কী করবেন? ঘুষ নেবেন? অবৈধ পন্থা অবলম্বন করবেন? নইলে আপনার সামাজিকতা রক্ষা হয় না যে!
অমুক শিল্পপতির তমুক স্ত্রী কোন উপলক্ষে একটি ভোজসভার আয়োজন করেছে। এতে আপনার স্ত্রীকেও আমন্ত্রণ করা হয়েছে। অনুষ্ঠানের খাবারের মধ্যে রয়েছে ময়ূরের মাংসের রোস্ট, দুষ্প্রাপ্য কোন পাখির জিহ্বা ভুনা, মিষ্টান্ন আনা হয়েছে ইটালীর রাজধানী রোম থেকে। আরও অনেক অতি বড়লোকীয় আয়োজন। তো এখন আপনার স্ত্রীকেও কি এসব করতে হবে সামাজিকতার নামে?
সবকিছু হতে হবে এই অদৃশ্য ও অযৌক্তিক সামাজিকতার সাথে পাল্লা দিয়ে। এ সব করতে গিয়ে যদি শাব্দিক অর্থেও আপনার শ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হয়, তাহলেও কিছু করার নেই। কারণ এটা সামাজিকতা। এ সব না করলে মানুষ কি বলবে!
মানুষ, সমাজ, সামাজিকতা- সব কিছু এদেরই জন্য। শ্বাসটাও ফেলতে হবে সামাজিকতা রক্ষা করে। পৃথিবীতে অল্প যে ক'টা দিন আমরা আছি, তাতে নিজেদের জন্য আমরা কবে বাঁচতে শিখব? কবে আমরা আমাদের হৃদয়ের স্পন্দন শুনতে পাব? কবে আমরা শরীয়তের ডাকে লাব্বাইক বলব? হৃদয় ও আত্মার প্রাণশক্তিতে যারা শক্তিশালী, তারা কোথায়? কবে তারা সামাজিকতার এই অদৃশ্য শিকল ভেঙে মানবতাকে মুক্তি দেবে?
আল্লাহর শোকর, আমি কখনই এ সব ফালতু বিষয়কে পরোয়া করিনি। মাঝে মাঝে খুব বিরক্তি লাগে এসবের কারণে। তাই কিছু কিছু কথা বলি। যারা শোনার, শুনবে। যারা বোঝার, বুঝে নেবে।
প্রথম কথা হলো ধর্মীয় অনুশাসনগুলো মেনে চলতে হবে। হারাম বা অবৈধ সবকিছু থেকে দূরে থাকতে হবে। তারপর যে জিনিসটার কারণে আমরা মানুষ অন্য সব সৃষ্টি থেকে শ্রেষ্ঠ, সেই আকল বা বুদ্ধি-বিবেকের সদ্ব্যবহার করতে হবে। তখন যেটা অধিক কল্যাণকর মনে হবে, সেটা করবে। পা যতটুকু লম্বা, ঠিক সে অনুযায়ীই মানুষ সামনের কদম বাড়ায়। তেমনি সামর্থ অনুযায়ী ও প্রয়োজন অনুপাতেই খরচ করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় কোন খরচ বা অপচয় কখনই গ্রহণযোগ্য না। বিরাট কোটিপতি হলেও না। আর যতক্ষণ পর্যন্ত আমি কোন হারাম বা অবৈধ কাজে জড়িত না হচ্ছি, ততক্ষণ পর্যন্ত —মানুষ কি বলবে!'- এ ধরণের চিন্তা করার কোন মানে হয় না। মানুষের কাজই হলো বলা। এই বলাবলি ছাড়া মানুষ আর কিই বা করতে পারে! মানুষ তো আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পাগল বলেছে। বলেছে চরম মিথ্যাবাদী, জাদুকর।তো আজকে সেই মানুষ আর সেই সমাজ কোথায়! আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! কোন আলোচনায় যার নাম উচ্চারিত হলে দরূদ পড়া ওয়াজিব। সে দরূদের উসিলায় আবার দশটি রহমত নাযিল হয়।
এই জন্য যারা বলতে চায়, তাদেরকে তাদের মত বলতে দিন। যতক্ষণ আপনি পর্যন্ত আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির পথে আছেন, মানুষের অসন্তুষ্টি নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই।
প্রবন্ধটি শায়খ আলী তানতাভী রহ. লিখিত مع الناس কিতাব থেকে অনুদিত
كل شيء للناس
من عادتي أن لا أركب إن استطعت المشي، ولا أمشي في الظل إن قدرت أن أمشي في الشمس، سواء علي في ذلك شمس لبنان في تشرين وشمس الهند في تموز.
وكان النهار أمس صائفًا حارًا، فحللت هذا الرباط عن عنقي وطويته ووضعته في جيبي فمرّ بي صديق أحبه وأحترمه، ولكني أنكر عليه أنه يتمسك بالعادات أكثر من تمسك العابد بالدين، ويحرص على رضا الناس أشد من حرص الزاهد على رضا الله.
فلم يكد يفرغ من السلام حتى أقبل عليّ صارم الوجه بادي الاهتمام فقال: وكيف تصنع هذا؟
فارتعبت وقلت: وماذا صنعت؟
وجعت أذكر: هل أحدثت في الإسلام حدثًا؟ أو آويت محدثًا أو جنية جناية؟ فلما لم أذكر قلت: وضّح يا أخي وقل لي ما الذي بلغك عني، فلعل الذين بلّغك فاسق أو كاذب.
قال: ما يلّغني أحد ولكني أرى بعيني. وأشار إليّ. قلت: وما ذاك؟
قال: العقدة (الكرافات). كيف تمشي بلا عقدة؟ هذا لا يليق بمستشار(كان وقتها مستشارا بالمحكمة ). ماذا يقول عنك الناس؟
فتركت الحوار وقعدت أفكر... فإذا نحن نعمل كل شيء للناس. نخنق أنفسنا بهذه العقد التي نضعها في أعناقنا كالأرسان ونتكلف منها في حر الصيف ما لا يُطاق من أجل الناس ! والنساء يتخذن هذه الأحذية الفظيعة ذوات الكعوب العالية مع أن المشي بها أصعب من المشي على الحبل. ومّن لم يصدّق من الرجال فليمشِ مئة خطوة على رؤوس أصابع قديمه! وهي – فوق ذلك – تُصلّب عضلات الساق وتشوّه جمالها، وما للبسها معنى وليس فيها جمال، ولكن هكذا يريد الناس !
ورأيت مرة امرأة واقفة في الترام والمقاعد خالية، وكلما دعوها لتجلس أبت، ثم تبين لي أنها تلبس إزارًا (خرّابطة أو جونيلا) ضيقا عجيبًا لا تستطيع معه المشي إلا كمشي المقيّد بالحديد، ولا تستطيع صعود درجة الترام إلا بكشف رجليها وإخراجهما منها، فلذلك لا تستطيع القعود.
تتساءلون: لماذا تعذّب نفسها هذا العذاب؟
من أجل الناس !
ومن الشبّان من يصفف شعر رأسه تصفيفًا فنيًا يشتغل به نصف ساعة, ويبقى النهار كله خائفًا أن تهب نسمة هواء أو أن تقترب منه يد طائشة في الترام فتفسد هندسته. وربما أدركته الحكة فاحتمل ألمها طول النهار ولم يستطع أن يمد أصبعه فيحكه، لماذا؟ لأجل الناس ! وكل خير هو للناس !
المرأة ظرفها ولطفها للناس. تقابل ضيوفها وصديقاتها بالوجه المشرق والفم الباسم والجَرْس الناعم والأدب البالغ, وزوجها ليس له إلا التجهم والنظر الشزر واللفظ الجافي. وكذلك يصنع الزوج ! وزينتها للناس, إذا خرجت تزيّنت للغرباء وتعطرت وارتدت أجمل أثوابها , وزوجها لا تلقاه إلا منفوشة الشعر كالحة الوجه, تسبقها روائح السمن والبصل والثوم. وكذلك يصنع الزوج !
والمائدة المربَّة في غرفة الطعام للناس؛ فإذا جاء الناس صُفّت الأطباق والصحون ونُضدت الأوراد والزهور, وإن لم يكن أحد كان الأكل في المطبخ. وغرفة النوم ذات الأسرّة المرتبة والأغطية المطرزة ليراها الناس, وأصحابها ينامون في غرفة أخرى فيها أسرّة من حديد ولحف بلا ملاحف !
نتعب أنفسنا ونقيد أعناقنا وأرجلنا للناس, وكل خير عندنا للناس. وإن أردنا أن نزوج البنت لم ننظر إلى مصلحتها ومصلحة زوجها ولم نفكر في إسعاد حياته وحياتها, ولكن فكّرنا في أيام العرس وحدها وسعينا لإرضاء الناس فقط. لا نسأل (إلا قليلًا) عن أخلاق الرجل وطباعه, بل نسأل عن المهر الذي يدفعه لنقول للناس: "مهر بنتنا عشرة آلاف". وعن الجهاز ليراه الناس فيقولوا: "ما شاء الله, والله جهاز عظيم".
وعن حفلة العرس, نتسابق لإرضاء الشيطان بإضافة الأموال في هذا وأمثاله. ثوب العرس الذي لا يُلبَس إلا ليلة واحدة فقط يكلف مئتي ليرة على الأقل, وقد يصل ألفين. وعلب الملبّس ثمن الواحدة ليرة على الأقل, وقد تصل إلى العشرين. وفيمن كل ذلك؟ لفائدة العروس؟ لا والله. للثواب والجنة؟ لا والله. لكسب المال؟ لا والله. فلِمَ إذن؟ للناس !
والناس – بعد ذلك – لا يرضون ؛ لأنك مهما أنفقت فإن في الناس من بنفق أكثر منك, فيقولون: " ما هذه الحفلة؟ وما هذه العلب؟ علب فلان كان ثمنها أكثر وحفلة فلانة كانت أكبر".
والمآتم مثل الأفراح؛ كلها تسابقٌ إلى إضاعة المال. وياليت الأمر يقتصر على أصحاب العرس أو عائلة الميت. لا؛ ولكن كل زواج وكل وفاة فيها نكبة ثلاثين أسرة.
يكون الزوج المسكين قد أعد مشروع موازنة الشهر, وسهر الليالي وضرب الأخماس بالأسداس حتى استطاع أن يسدد حاجة الأسرة براتبه الذي لا يتجاوز ثلاثمئة ليرة في الشهر؛ يشد لحافه ليغطي كتفيه فيكشف عن رجلية, فإذا ستر رجليه انحسر كتفيه ! وينما هو في ذلك إذ خطر على بال عمة امرأة خال زوجته أن تموت فجأة, فتجئ الزوجة تطلب حالاً وبلا تأخر وبالسرعة الكلية (على لغة المبايعات الرسمية) أربعين ليرة ثمن ثوب أسود للعصرية. فيقول: "اسمعي يا امرأة, إن موازنتنا لا تتحمل". فتبكي وتعول وتقول: وكيف أذهب إلى عصرية الفقيدة العزيزة المرحومة المأسوف على شبابها عمة زوج خالي بلا ثوب أسود, وماذا يقول عني الناس؟
قد تكون هذه العزيزة المأسوف على شبابها بنت تسع وسبعين سنة فقط, وقد تكون منقطعة عن زيارتها من ست سنين, ولكن الحكاية حكاية: ماذا يقول الناس؟
وإذا كنت مشغولاً بإعداد درسك في المدرسة, أو حساب عملائك في المتجر, أو تمريض بنتك المشرفة على الموت, وإذا كان لديك شغل الذهب وجاءك –فجأة بلا موعد_ أحد العاطلين المعطّلين الفارغين ليقطع الوقت باللَّتّ والعجن معك, فلا تقل له: " أنا مشغول". إاك, وإلا فأنت أعلم بما يقوله عنك الناس !
وإذا كان جارك أو عديلك غنيًا يملك الملايين وكنت أنت مستورًا ليس لك إلا راتبك, واشترى لبيته ثُريّا بألف ليرة وبرّادة وغسّالة وعصّارة كهربائية وفرنًا على الغاز وسجادة طولها ثمانية أمتار وعرضها خمسة, فاذهب حالاً فاشترِ مثلها ولو سرقت ونهبت وقطعت الطريق, وإلا أوقعت نفسك في أفواه الناس !
وإذا أقامت زوجة التاجر الفلاني أو الوارث العلاّني وليمة, دعت إليها امرأتك وقدمت فيها لحم الطواويس وألسنة الشحارير, والحلويات المصنوعة في روما الواردة بالطيارة الخاصة, فيجب أن تعد زوجتك مثل ذلك وإلا تكلّم عنها الناس !
والخلاصة: أنه يجب ان يكون قيامك وقعودك وأكلك ولبسك وفرش بيتك ونفقات يومك كما يريد الناس أن تكون, ولو اختنقتَ حسًا ومعنى, ولو نُكبت في سعادتك وفي مالك, ولو احترق نَفَسُك, وإلا انتقدك الناس!
الناس, دائمًا الناس ! فيا أيها الناس, متى نعيش لأنفسنا؟ ومتى نستطيع أن نقف عند حد الشرع وحد العقل؟ ومتى يخرج فينا العقلاء الأقوياء الذين يكسرون هذه القيود؟
أمّا أنا فو الله ما أبالي هذا كله, ولكن أعظ من شاء أن يتعظ: أن يتبع دينه أولاً فلا يأتي محرمًا, ثم يتبع العقل, ثم يعمل ما يراه خيرًا ويمدّ رجليه على قدر لحافه وينفق النفقة الضرورية ويترك التبذير ولو كان أغنى الأغنياء. ولا تخشوا قول الناس ما دمتم لم ترتكبوا محرمًا ولا ممنوعًا شرعًا. وهل عند الناس إلا أن يقولوا؟! لقد قالوا عن محمد – صلى الله عليه وسلم – (وهو خاتم الأنبياء): مجنون وقالوا: ساحر, وقالوا: كذّاب. فليقولوا عنكم ما شاءوا, ولا تبالوا بسخط الناس إن كنتم قد أرضيتم الله.
المصدر: مع الناس بقلم الشيخ علي الطنطاوي