بـسـم الله الـرحـمٰـن الرحـيْـم

    • রহিম মার্কেট, সানারপাড়
    • সিদ্ধিরগঞ্জ, নারায়নগঞ্জ, ঢাকা
    • রহিম মার্কেট, সানারপাড়
    • সিদ্ধিরগঞ্জ, নারায়নগঞ্জ, ঢাকা

লেখালেখি

blog banner

আজকের কাজ আগামীকালের জন্য ফেলে রেখো না

ঠিক এই মুহূর্তে আমি কঠিন বিপদে আছি। সফরের জন্য গোছগাছ করছি, গাড়ি গেইটে দাঁড়ানো। অথচ যে বক্তৃতাটা দেয়ার জন্য এই সফর, সেটাই এখনও তৈরি করিনি। আর এখন এই শেষ মুহূর্তে যখন কাগজ কলম নিয়ে বসেছি, মাথার মধ্যে একটার পর একটা বিষয়বস্তু এসেই চলেছে। একদম বৃষ্টির ফোঁটার মত। একটা মাটিতে না পড়তেই আরেকটা তার পিছু পিছু এসে পড়ছে। মাথার দু'পাশের রগ যে লাফাচ্ছে, স্পষ্ট টের পাচ্ছি। হতাশায় একদম কাগজ কলম ফেলে দিয়ে উঠে যেতে ইচ্ছে হলো।

তারপর চিন্তা করলাম, এই যে আমি এখন লিখতে পারছি না, এর কারণ কী? এটা নিয়েই একটু চিন্তা করে দেখি না কেন! হয়ত এর থেকেই কোন একটা বিষয় দাঁড়িয়ে যাবে।

মূলত দু'টি কারণে আমার এখন এ অবস্থা। প্রথমত, আমি আমার সাধ্য-সীমার বাইরের একটি দায়িত্ব নিয়েছি। আমি কোর্ট-কাচারির মানুষ। পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করি। রেডিওতেও বিভিন্ন আলোচনা করি। তো আমি যদি এগুলোর মধ্য থেকেই কোন একটা দায়িত্ব নিতাম, তাহলে সেটা আমার জন্য সহজ হতো। কিন্তু সুদূর কুয়েত গিয়ে নির্দিষ্ট একটি বিষয়ে বক্তব্য পেশ করা, আমার জন্য এটা একটু বেশিই হয়ে গেল।

দ্বিতীয় কারণ আমার গড়িমসি করার বদ অভ্যাস। আজকের কাজ কালকের জন্য রেখে দেয়া। মূল কাজ রেখে অন্য কাজে সময় নষ্ট করা। এর কারণে বেশির ভাগ সময়ই দেখা যায়, লেকচারের সময় হয়ে গেছে অথচ এখনও সেটা তৈরিই হয়নি। অল্প কিছু সময় বাকি। তখন আমি ঐ গল্পের খরগোশটার মত লাফিয়ে উঠি। অথচ সময় মত যদি আমি গল্পের ঐ কচ্ছপটার মত ধীরে ধীরে হলেও কাজ শুরু করে দিতাম, তাহলে এতটা কষ্ট ও পেরেশানির শিকার হওয়া লাগতো না।

আচ্ছা, এই যে গড়িমসি করা, টালবাহানা করা, এই রোগে কি আমি একাই আক্রান্ত? এমন কি কারো সাথে কখনো হয়নি যে, ঈদের মৌসুমে আপনি দর্জির কাছে কাপড় বানাতে দিলেন। দর্জি ডেলিভারির তারিখ দিল ১৫ রমযান। কিন্তু ঈদের আগের রাতেও সে আপনার কাপড় আপনাকে বুঝিয়ে দিতে পারলো না? খোঁজ নিলে দেখা যাবে, যে দর্জি সাধারণত এক মাসে দশটা অর্ডার নিত, সে নিয়েছে বিশটা অর্ডার। এ কারণে সে সময় মত কাজগুলো শেষ করতে পারেনি। সমাজের সব ধরণের কাজের ক্ষেত্রেই আমরা এই দর্জির উদাহরণ দেখতে পাবো।

এই যে কালক্ষেপণ করা, বিলম্ব করা, এটা আমাদের সবার মাঝেই কমবেশি আছে। এটি একটি সামাজিক ব্যাধি। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, সমাজ থেকে নিয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত প্রতিনিয়ত আমাদের যে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে, এর মূলে রয়েছে দায়িত্বের প্রতি এই অবহেলা ও টালবাহানা।

প্রত্যেক পিতামাতাই তাদের সন্তানদের সঠিক লালন-পালন করতে চায়। তাদের মানসিক ও শারিরীক বিকাশের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কিন্তু তারা নিজেরাও এ কথা জানে যে, সন্তানের লালন-পালনের ব্যাপারে তারা চাইলে আরও একটু সচেতন হতে পারে। একই কথা একজন ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রে। সে চাইলে তার ব্যবসার কার্যক্রম আরও একটু উন্নত ও আন্তরিকতার সাথে সম্পন্ন করতে পারে। তেমনিভাবে প্রতিটি পরিবারের কর্তাই তার পরিবারকে পরিচালনার ক্ষেত্রে আরও একটু সততা ও সচেতনতার পরিচয় দিতে পারে। কিন্তু কেউই এই —আরও একটু' সচেতন হওয়া, —আরও একটু' আন্তরিক হওয়ার শুরুটা করতে চায় না। প্রথম কদমটা রাখতে চায় না। তাই প্রতিদিন একই সূর্যের উদায়াস্ত আমাদের কাছে একঘেয়ে লাগে। একটি নতুন দিনের নতুন সূর্যের উদয় থেকে আমরা কোন বার্তা পাই না। দিন শেষে সেই সূর্যের অস্ত যাওয়াতে আমরা কোন শিক্ষা পাই না।

যারা ধূমপান করে তাদের প্রায় সবাই বলে, এটা আমি শীঘ্রই ছেড়ে দেবো। কিন্তু তার এই — শীঘ্রই'টা আজকে আর হয় না। কালকেও এই —শীঘ্রই' আসে না। এমনিভাবে দিনগুলো চলে যায়। আর সে তার মতই রয়ে যায়।

যাদের অতিরিক্ত খরচ করার অভ্যাস, তাদের কেউ হয়ত ভাবে, এই শেষ। এটা কেনার পর সামনে থেকে আর কোন অপ্রয়োজনীয় খরচ করবো না। কিন্তু তার এই —সামনে থেকে'টা সব সময় সামনেই থেকে যায়। শুরুটা আর করা হয় না।

কোন দ্বীনী মজলিসে কোন দরদে-দিল আলেমের বয়ান শুনে মাঝে মাঝে হয়ত আমাদের খুব অনুশোচনা হয়। মনে মনে বলি, ভাল হয়ে যাব। কিন্তু এই —ভাল হওয়া'টা আমরা শুরু করি না। নতুন কোন গুনাহে লিপ্ত হই, আর মনে মনে বলি, রমযান মাস আসলে একেবারে তওবা করে ভাল হয়ে যাব। যখন রমযান আসে তখন বলি, সামনে হজের মৌসুম। হজ করে একেবারে নিষ্পাপ হয়ে ঘরে ফিরবো। তারপর হজের সময় হলে বলি, লাইফটা তো মাত্র শুরু হলো। এখন যদি একটু এনজয় না করি, তো কখন করবো! চুল-দাড়ি সাদা হোক, তখন সারাদিন মসজিদে বসে থাকা যাবে। ঠিক এমনিভাবে আমাদের জীবনের বসন্তগুলো একে একে সবগুলো রঙ হারিয়ে ধূসর ফ্যাকাশে হয়ে পড়ে, কিন্তু গাফলতের ঘুমটা আর ভাঙে না।

জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং যুক্তি ও প্রযুক্তিতে অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে আমরা এগিয়ে। অর্থাৎ আমাদের জ্ঞানের কোন অভাব নেই। সবাই সবকিছু জানি। মিথ্যা বলাটা ভাল কাজ না এবং সত্য বলাটাই অধিক কল্যাণকর, এটা কে না জানে! আমরা সবাই জানি, আমাদের উপর আমাদের পিতামাতার কিছু হক রয়েছে। আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা ওয়াজিব। কাউকে ধোকা দিলে, কারো উপর জুলুম করলে, কারো প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করলে আল্লাহ নারায হবেন। এগুলো আমরা সবাই জানি। কিন্তু আমাদের এই জানা, আমাদের এই জ্ঞান আমাদের জীবনে কোন কাজেই লাগছে না। কারণ এগুলোর ব্যাপারে আমাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।

আমার আব্বাজান রহ. যখনই আমাকে ফজরের নামাযের জন্য ডাকতে আসতেন, বলতেন, —আর গড়াগড়ি করো না, লাফ দিয়ে উঠে পড়ো।' কিন্তু আমি অলসতা করতাম। ঘুমের ভান করে পড়ে থাকতাম। তার ডাকের জবাব দিতাম না। কিংবা হালকা একটু সাড়া দিতাম, কিন্তু উঠতাম না। এক সময় তিনি বিরক্ত হয়ে ফিরে যেতেন। আর এখন আক্ষেপে আমার হাতের আঙ্গুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠে। আব্বা যখন আমাকে ডাক দিয়ে বলতেন, —লাফ দিয়ে উঠে পড়ো' তখন যদি আমি উঠে পড়তাম, অথবা তিনি যদি আমাকে জোড় করে উঠিয়ে দিতেন, তাহলে আমার জীবনটা আজ অন্য রকম হতো। আমার দুনিয়া ও আখেরাতের সম্পদ আরও সমৃদ্ধ হতো। আর আজকের এই বক্তৃতাটা তৈরি করতে এত পেরেশান হওয়া লাগতো না।

এখনও যখন ভোরে ঘুম থেকে ওঠার সময় হয়, আব্বার সেই কণ্ঠস্বর আমার কানে বাজতে থাকে- —গড়াগড়ি করো না, উঠে পড়ো। লাফ দিয়ে উঠে পড়ো। নামায, ঘুম থেকে নামায অধিক কল্যাণকর।'

তারপর আসে শয়তানের কুমন্ত্রণা- —আরেকটু ঘুমিয়ে নাও। এখনও অনেক সময় আছে। বিছানাটা কি আরামদায়ক! এই ঠাণ্ডার মধ্যে বের হওয়ার কি দরকার!'

ঘড়ির পেণ্ডুলামের মত আমি দুলতে থাকি কর্তব্যের ডাক আর অলসতার মাঝে। নামাযের ফযীলতের কথা চিন্তা করে উঠতে ইচ্ছে করে। আবার এই আরামের বিছানায় শুয়ে থেকে ঠাণ্ডা পানির কথা মনে হতেই পার্শ্ব পরিবর্তন করে আরেকটু গড়াগড়ি করি। টিক টিক করে প্রতি মুহূর্তে ঘড়ির কাঁটার জায়গা পরিবর্তনের মত আমার মনটাও প্রতি মুহূর্তে বদলাতে থাকে। একবার এদিক আরেকবার ওদিক। তারপর এক সময় পরম করুণাময়ের রহমত আমাকে স্পর্শ করে। তখন আমি মুয়াজ্জিনের ডাকা সাড়া দিতে পারি। অথবা শয়তানের ধোঁকায় পড়ে গাফলতের ঘুমের অতলে তলিয়ে যাই। যখন ঘুম ভাঙে, সূর্যটা তখন অনেক উপরে উঠে গেছে। অফিসে যাবারও সময় হয়ে এসেছে প্রায়। শুরু হয় আমার ছোটাছুটি। গোগ্রাসে সকালের নাস্তাটা কোন রকম মুখে দিই। গলায় আটকে যায়, পানি দিয়ে নামিয়ে দিই। তাড়াহুড়ো করে জামা পড়তে গিয়ে বোতাম একটার জায়গায় আরেকটা লাগিয়ে ফেলি। টাইটাও ঠিকভাবে বাধা হয় না, একদিকে কাত হয়ে থাকে। তারপর বের হওয়ার সময় চশমা আর ঘড়িটা ভুল করে ঘরেই ফেলে আসি। রাস্তার মধ্যেও তাড়াহুড়ো করি, কারণ সময় নেই। মানুষের হাসির পাত্র হই। এ সব কিছুর মূল হলো ফজরের নামাযের জন্য সময় মত না ওঠা। তখন যদি এক লাফে উঠে পড়তাম, তাহলে এ সাধারণ কাজগুলোর জন্য আর এতটা পেরেশান হওয়া লাগতো না।

প্রতিদিন যত ব্যস্ততাই থাক, কমপক্ষে ১০০ পৃষ্ঠার উপরে আমার পড়া হয়। কিন্তু এর বেশির ভাগই হয়ে থাকে অনর্থক। শিক্ষণীয় কিছু এগুলোতে থাকে না। বিজ্ঞান, সাহিত্য বা চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধনমূলক কিছুই এ সবের মধ্যে থাকে না। ভাল বই যে আমার কাছে নেই তা না। আছে এবং প্রচুর পরিমাণেই আছে। আমি নিজেই কিনেছি এগুলো পড়ার জন্য। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। সুন্দর করে সাজিয়ে রেখে দিয়েছি। যখনই এগুলো পড়ার একটু ইচ্ছে হয়, হাতে নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করি, উল্টেপাল্টে দেখি। মনে হয়, কত লেখা! কখন পড়বো এগুলো! এত সময় কোথায়! আচ্ছা ঠিক আছে, কালকে থেকে পড়া শুরু করবো। কিন্তু আগামীকাল যখন বর্তমানে আসে, তখন সাথে করে আরেকটা আগামীকাল নিয়েই আসে। আর এমনিভাবে দিনগুলো আস্তে আস্তে সপ্তাহ, মাস এবং বছরে প্রলম্বিত হয়। আমার সেই —কালকে' আর শুরু করা হয় না। টালবাহানা আর সিদ্ধান্তহীনতার মাঝে আমি চক্রাকারে ঘুরতে থাকি।

এই একটি মাত্র ব্যাধি যখন সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তার জীবাণু ছড়াতে থাকে, তখন কি বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ যে নষ্ট হয়, কে তার হিসাব রাখে!

বর্ষাকাল আসলে আমাদের রাস্তাঘাট ও পানি নিষ্কাশনের সমস্যাটি রাষ্ট্রীয় সমস্যার রূপ নেয়। বক্তৃতা-বিবৃতি, মিটিং-মিছিল, সভা-সমাবেশ আরো কত কি! কত কল্পনা ও পরিকল্পনা হয়, কত যে ড্রইং আর ম্যাপ বানানো হয় আধুনিক সড়কের! এ সব করতে করতেই বর্ষাকাল শেষ। তখন জাগ্রত জনতার জাগরণ ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে ঘরমুখো হয়। আর যে রাস্তা ও ড্রেনের জন্য এত সভা-সমাবেশ, সেগুলো আগের মতই পড়ে থাকে আগামী বর্ষার জন্য।

১৯৩৬ সালের কথা। আমি তখন বাগদাদে। সে বছর দজলা নদীতে এমন জলোচ্ছ্বাস হলো যে, বন্যার পানিতে পুরো বাগদাদ প্রায় ডুবে যাওয়ার মত অবস্থা। তখন সাধারণ মানুষ নিজ থেকে উদ্যোগী হয়ে সাময়িকভাবে একটি বাঁধ তৈরী করে পরিস্থিতি সামাল দেয়। কিন্তু বন্যার পানি যখন নেমে গেল এবং সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এল, তখন এ ব্যাপারে আর কারো কোন মাথাব্যথা নেই। সব আগের মত। এমন কি এখন পর্যন্ত এ বাঁধের ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

প্রত্যেকটা বিগ-বাজেট পরিকল্পনাকেই রাষ্ট্রীয়ভাবে মরফিন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। তাই বিপদের সময় বাধ্য হয়ে যখন সে কাজে হাত দিতে হয়, তখন একেবারে লেজে-গোবরে অবস্থা করে ছাড়ে।

আমরা কখনই সময়ের কাজটা সময়ে করতে অভ্যস্ত না। দুনিয়ার মানুষ ওয়াদা খেলাফীর ব্যাপারে এখন প্রাচ্যের মানুষদের উদাহরণ দেয়। প্রাচ্যের দেশগুলোতে যতবারই আমি সফর করি, এ বিষয়টার সত্যতা ও প্রমাণ ততবারই আমার কাছে আরও প্রকট হয়ে ধরা দেয়। উদাহরণস্বরূপ পাকিস্তানের কথা বলা যায়। সেখানে আমি কখনই কোন অনুষ্ঠান সময় মত হতে দেখিনি। হয়ত আমন্ত্রিত মেহমানদের কেউ এক ঘণ্টা বিলম্ব করে এসেছেন, নয়ত অন্য কিছু্। অথচ যদি দুনিয়ার সব মানুষের জন্যও ওয়াদা খেলাফী করা জায়েয হতো, তারপরও মুসলমানদেরকে কখনই এর বৈধতা দেয়া হতো না। কারণ তাদের ধর্মের ভিত্তিই হলো সময়-জ্ঞানের কঠিন গুরুত্বের উপর। একটা মিনিট বা সেকেন্ডের হেরফের সহ্য করা হয় না এ ধর্মে। যেমন কেউ যদি নামাযের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার মাত্র পাঁচ মিনিট আগে নামায পড়ে নেয়, তাহলে সেই নামাযের কোনই মূল্য নেই। তেমনিভাবে রমযানে সারাদিন রোযা রেখে মাগরিবের আযানের মাত্র পাঁচ মিনিট আগে যদি কেউ খেয়ে ফেলে, তাহলে এই রোযার এক কানাকড়িও মূল্য নেই। আরাফার ময়দানে অবস্থান করার যে সময়সীমা, তার মাত্র পাঁচটা মিনিট পরে কেউ যদি সেখানে উপস্থিত হয়, তাহলে তার এই হজেরও কোনই মূল্য নেই।

এ সব কিছুর উদ্দেশ্যই হলো সময়ের গুরুত্ব দেয়া। সময়ের গুরুত্বকে অনুধাবন করতে শেখানো। নইলে গরমের সময় যে রোযাদার ১৪ ঘণ্টা রোযা রাখছে, তার থেকে পাঁচটা মিনিট কম হয়ে গেলে কি এমন ক্ষতি হয়ে যাবে! অথচ শীতের সময় তো এর দুই ঘণ্টা কম ১২ ঘণ্টা রোযা রাখা লাগে! অর্থাৎ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সময়কে এবং সময়জ্ঞানকে গুরুত্ব দেয়ার শিক্ষা। অন্যথায় অলসতা, গড়িমসি আর টালবাহানার বেড়াজালে জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ বেকার নষ্ট হয়ে যাবে।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মুনাফেকের আলামত হলো তিনটি। যখন সে কোন কথা বলবে, মিথ্যা বলবে। যখন কোন ওয়াদা করবে, সে ওয়াদা ভঙ্গ করবে। আর যখন তার কাছে কোন আমানত রাখা হবে, সে আমানতের খেয়ানত করবে।

তো আল্লাহর রাসূলের এ হাদীস অনুযায়ী ওয়াদা খেলাফী করা হলো, মুনাফেকের প্রধান তিনটি স্বভাবের একটি নিজের মধ্যে ধারণ করা।

ইসলাম অনির্দিষ্ট বা যেনতেন কোন ওয়াদাকে সমর্থন করে না। যেমন- —জোহরের আগে' বা —মাগরিবের পরে' অথবা —দুই নামাজের মাঝখানে' ইত্যাদি। এগুলো হলো অনিশ্চিত ও অনির্দিষ্ট ওয়াদা। (ইংরেজিতে বলতে গেলে- কনফিউজিং)।

ইসলামের সময়সূচী হলো সুনির্দিষ্ট ও স্পষ্ট। যেমন নামায, সেহরী, ইফতার ইত্যাদির সময়সূচী। এগুলোর সময় পরিষ্কারভাবে মিনিট ও সেকেন্ডসহ উল্লেখ করা থাকে। যাতে করে মুসলমানরা এ পৃথিবীতে সময়ের গুরুত্ব অনুধাবন করতে সক্ষম হয়।

প্রিয় পাঠক ও পাঠিকা! শিকারি যদি সঠিক মুহূর্তটিতে ট্রিগার না দাবায়, তাহলে হরিণটি তার জন্য বসে থাকবে না। কামার যদি লোহাকে লাল অবস্থায় আঘাত না করে, তাহলে পরে আর সেটাকে পরিবর্তন করা সম্ভব হয় না। সুতরাং কর্তব্য যদি সঠিক সময়ে পালন করা না হয়, তাহলে অন্য সময় সেটা করে ফেললেও পূর্ণাঙ্গ হয় না।

সুতরাং হে ধূমপায়ী! যদি সত্যিই ধূমপান ছেড়ে দেয়ার ইচ্ছা থাকে, তাহলে আর এক মুহূর্তও দেরি করো না। আধখাওয়া সিগারেটটা এখনই ছুঁড়ে ফেলে দাও।কারণ এই একটি মুহূর্ত শেষ হওয়ার আগে আরেকটি মুহূর্তকে টেনে আনবে। সময় এমনি এমনি বয়ে যাবে। তুমি ধূমপানের হাত থেকে আর নিস্তার পাবে না।

শিক্ষার্থী বন্ধু আমার! তুমি যদি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে চাও, তাহলে আজ এই এখন থেকেই শুরু করো। আগামীকালের জন্য অপেক্ষা করো না। কারণ এই আগামীকালের দেখা তুমি কখনই পাবে না। কিন্তু পরীক্ষা একদিন তোমার সামনে ঠিকই চলে আসবে। অথচ তুমি কোন প্রস্তুতি ছাড়া বসে আছ সেই অদৃশ্য আগামীকালের অপেক্ষায়।

প্রিয় বোন আমার! তুমি যদি নিজেকে সত্যিই সংশোধন করতে চাও, যদি নিজের আত্মা ও বিবেকের প্রতি বিশ্বস্ত হতে চাও, তাহলে আজ এই মুহূর্ত থেকেই নিজের স্বামী-সন্তানের ব্যাপারে আরও একটু সচেতন হও। তাদেরকে আরও একটু ভালবাসা দাও। লোক দেখানো ভালবাসা না। হৃদয়ের গভীর থেকে ভালবাসো। আজকের এই মুহূর্তেই হৃদয়টাকে তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দাও।

যারা সত্যিই বিশ্বাস করে যে, এই জগতের পর আরেকটি অন্তহীন জগত রয়েছে, এই জীবনের একটি শেষ মনযিল আছে; যারা সত্যিই বিশ্বাস করে যে, কৃতকর্মের হিসাব দিতেই হবে এবং পুলসিরাতের উপর দিয়ে যেতেই হবে আর তারপর জান্নাত বা জাহান্নামের ফয়সালা হবে; যারা সত্যিই এ বিশ্বাস হৃদয়ে ধারণ করে তাদের উদ্দেশ্যে বলি, আর বসে থাকবেন না। আজ এই মুহূর্তে তওবা করুন। আগামীকালের জন্য অপেক্ষা করবেন না। আগামীকালের তাকদীরে কি আছে, কে তার খবর রাখে!

—আজকের কাজ আগামীকালের জন্য ফেলে রেখো না' – একটি বড় ফ্রেমে বাঁধাই করে লেখাটি নিজের রুমে লাগিয়ে রাখুন। এই একটি কথাকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারলে জীবনে সফল হওয়ার জন্য আর কিছুর প্রয়োজন নেই।

প্রবন্ধটি শায়খ আলী তানতাভী রহ. লিখিত مع الناس কিতাব থেকে অনুদিত

أنا الآن في ورطة؛ يدي تعدّ حقائب السفر، ورجلي في الركاب، وعليّ أن أكتب هذا الحديث وأن أعدّ المحاضرات التي دُعيت لإلقائها في الكويت، والموضوعات تتزاحم في رأسي وتتضارب وتتراكض حتى لأحسّ بها تضرب أصداغي، وكلما شرعت في موضوع ورد عليّ طرف من الموضوع الآخر، حتى تداخلني اليأس، فكدت ألقي القلم وأعترف بالهزيمة.

ثم قلت لنفسي: لقد فشلت، ولكن لماذا لا أفكر في أسباب الفشل فأجعل منها موضوع الحديث؟

لقد فشلت لسببين: الأول أني حمّلت نفسي فوق ما أطيق، فأنا أعمل في المحكمة، وأكتب في أكثر من مجلة، وأذيع في الإذاعة، وأعدّ محاضرات. ولو اقتصرت على ما أستطيع حمله وأداءه على وجهه لنجحت.

والثاني: أن من طبعي التأجيل والتسويف؛ فأنا لا أزال أؤجل عمل اليوم إلى غدٍ، وأتشاغل عنه وأسوّف فيه حتى لا يبقى للمحاضرة أو الحديث إلا ساعات معدودة، فأركض ركض الأرنب. وكان خيراً لي وأهون عليّ لو مشيت من أول الوقت ولو مشي السلحفاة.

ولكن هل أنا وحدي الذي يحمّل نفسه فوق طاقتها؟ وهل أنا وحدي المبتلى بالتأجيل؟

أما يعدك الخياط أن يسلمك البذلة في نصف رمضان، فلا يزال يسوّف حتى تأتي ليلة العيد والبذلة لم تصل إليك؟ أليس السبب أن الخيّاط يُلزم نفسه بعشرين بذلة وهو لا يقدر على أكثر من عشر؟

أوَليس الحذّاء والبنّاء وأصحاب الأعمال كلها مثل الخياط، كلهم يحمل أكثر مما يطيق فيعجز عنه؟

والتأجيل ... أليس التسويف والتأجيل مرضنا جميعاً، بل هو -على التحقيق- رأس أمراضنا الاجتماعية وعلة عللنا؟ كل أب يعرف طريقة لتربية ولده خيراً من طريقته، وكل تاجر يجد أسلوباً لتوسيع تجارته أحسن من أسلوبه، وكل رجل يعرف الطريق لتحسين صحته وإصلاح سيرته في بيته مع أهله وزوجته، ولكن كل واحد من هؤلاء يؤجل الابتداء بهذا الإصلاح يوماً بعد يوم حتى تمر السنون الطويلة وهو لم يفعل شيئاً.

كل مدخّن يقول لنفسه: "سأترك التدخين"، ولكنه يؤجل تنفيذ هذه الإرادة من يوم إلى يوم، فتمضي السنوات وهو لا يزال كما كان. وكل مسرف مبذّر يعزم أن يقتصد ويزن نفقاته بميزان العقل، ولكنه يؤجل التنفيذ. وكل فاسق تدركه لحظات يسمع فيها آية أو موعظة، فيرقّ قلبه وتسمو نفسه ويعزم على التوبة ولكنه يؤجل، يقول: "سأتوب إذا جاء رمضان وأرجع إلى الله وأكون من الصالحين"، فإذا جاء رمضان قال: "سأحج وأتوب في الحج"، فإذا ذهب وقت الحج قال: "أنا الآن شاب وسأتوب إذا بلغت أواخر العمر". ويمضي العمر وهو لم يتب ولم يصلح.

ونحن لا ينقصنا العلم، بل ينقصنا الشروع في العمل بما نعلم. لا، لا ينقصنا العلم، إن كل واحد منا يعلم أن الكذب شر والصدق خير، وكل واحد منا يعلم أن للوالدين حقوقاً وأن صلة الرحم من الواجبات وأن الغش والظلم والعدوان من أسباب غضب الله، ولكنا لا نعمل بهذا الذي نعلمه.

ولقد كان أبي - رحمه الله- كلما أيقظني لصلاة الصبح يقول لي: "لا تتراخَ، اقفز قفزاً". فأتراخى وأتكاسل، ثم أتناوم فلا أرد، أو أردّ ولا أقوم، حتى يمل فيدعني.

وأنا أعض أصابعي الآن ندماً لأني لم أسمع هذه الوصية: «اقفز قفزاً». ولو أني سمعتها وعملت بها، أو لو أنه أجبرني عليها، لتغيرت حياتي ولما فشلت في إعداد هذا الحديث، ولكنت في دنياي وفي ديني خيراً مما أنا عليه اليوم.

وأنا -إلى الآن- كلما أردت أن أقوم في الصباح أحسّ هذه الكلمة، كلمة أبي تدوي في أذني: "اقفز قفزاً، قم إلى الصلاة فالصلاة خير من النوم". ثم أسمع صوت الشيطان يقول لي: "نم دقيقة أخرى، فالوقت فسيح، والفراش دافئ والجو بارد". ولا أزال بين داعي الواجب وداعي اللذة، أفكر في ثواب الصلاة فأتحفز للقيام، وأتصوّر لذة المنام وبرد الماء فأسترخي وأتقلب من جنب إلى جنب. ولا تزال نفسي بينهما كنوّاس الساعة (الرقاص)، بين: «قم»، «نم». «قم»، «نم». «قم»، «نم» ... حتى تدركني رحمة الله فأقفز، أو تطلع الشمس وتفوت الصلاة وأقوم وقد مضى الوقت ودنا العمل، فآكل طعامي لقمة بالطول ولقمة بالعرض، ولقمة تعترض في صدري فأغصّ بها، وألبس جورباً على الوجه وجورباً على القفا، وأعقد العقدة مائلة وأزرّر زر القميص الأول في العروة الثانية، وأنسى -من عجلتي- الساعة أو النظارات، وأهرول في الطريق؛ فأسيء هضمي، وأُتعب معدتي، وأُضحك الناسَ عليّ. وكل ذلك لأني أطعت الشيطان -لعنه الله- فلم أقفز قفزاً إلى صلاة الصبح.

وأنا أقرأ كل يوم مهما أقللت ومهما كنت مشغولاً أكثر من مئتَي صفحة، أكثرها مما لا يفيد علماً ولا يعلّم أدباً ولا يقوّم خلقاً، وأدع عشرات من الكتب الجدية النافعة، مع أني ما اشتريتها إلا لأقرأها. قد صففتها أمامي، ولكني كلما هممت بالشروع فيها أجدها كثيرة فأؤجلها إلى غد، ويأتي الغد فأحذفها إلى ما بعده. وتمضي السنون وما قرأت منها شيئاً، والسبب مرض التأجيل والتردد .

هذا المرض الذي طالما أضاع علينا أموالاً ومكاسب، وخيرات ومنافع، وأفقدنا الدنيا والدين، وهو مرض الجماعات منا والحكومات.

كلما جاء الصيف شكا الناس من فساد الطرق وسوء السيارات، وقلة الماء، وغلاء البيوت والمآكل، ووضعت الخطط للإصلاح ونهم بأن نشرع بها فيكون الصيف قد ولّى، فنؤجل ونسوّف حتى يجيء صيف جديد.

ولما كنت في بغداد سنة 1936 فاض نهر دجلة فيضاناً مخيفاً مرعباً صدع قلوب الناس وكاد يغرق بغداد كلها. ونادى منادي الخطر، وحشدوا الناس من الشوارع لإقامة السدود، فلما ذهب الخطر جاء التسويف وبقي الأمر كما كان إلى الآن. وكل مشروع من المشروعات الكبرى في بلاد هذا الشرق كلها: إما أن ينام على فراش التخدير بـ «مورفين» التسويف والتأجيل، وإما أن يجيء مرتجَلاً مشوَّهاً كجنين ولد قبل الأوان.

إنّا لا نؤدي واجباً في موعده، حتى صارت كلمة «الوعد الشرقي» رمزاً - مع الأسف- للوعد الذي لا يوثَق به ولا يُطمَأَنّ إليه، وكلما أوغلت في الشرق رأيت ذلك أظهر وأوضح، فلا تقام في باكستان حفلة في موعدها ولا يأتي ضيف إلا متأخراً ساعة، مع أنه لو جاز لكل أمة في الدنيا أن تهمل المواعيد وتتراخى فيها لما جاز ذلك للمسلمين، لأن دينهم يقوم على مواعيد مضبوطة ضبط الدقائق والثواني؛ فالذي يصلي قبل موعد الصلاة بخمس دقائق لا تصح صلاته، والذي يفطر قبل أذان المغرب بخمس دقائق لا يصح صومه، والذي يصل عرفة بعد انتهاء وقت الوقوف بخمس دقائق لا يصح حجّه.

وكل ذلك لتعليمنا ضبط المواعيد. وإلا فماذا يضر الصائم في الصيف إن صام أربع عشرة ساعة إلا خمس دقائق؟ ألا يصوم في الشتاء اثنتي عشرة ساعة؟ المراد أن نتعود النظام والضبط في أعمالنا كلها، وألاّ نصاب بطاعون التأجيل والتسويف وإخلاف المواعيد.

والرسول صلى الله عليه وسلم يقول: «آية المنافق ثلاث: إذا حدّث كذب، وإذا وعد أخلف، وإذا اؤتمن خان». فإخلاف الوعد والإخلال به ثلث النفاق! والإسلام لا يعرف هذه الوعود المائعة، الوعود الشامية العتيقة: «قبل الظهر»، «بين الصلاتين»، «بعد المغرب»، بل يعرف الوعد المضبوط ضبط الساعة، ضبط أوقات الصلاة وأوقات الإمساك والإفطار.

يا أيها السامعون والسامعات! إن الذي لا يقفز إلى الفريسة تفلت منه، ومن لا يغتنم الفرصة في وقتها لا يجدها، ومن لا يضرب الحديد حامياً لا يستطيع أن يضربه إذا برد، والذي يؤجّل ما يجب عليه لا يقدر أن يؤديه كاملاً.

فيا أيها المدخن! إذا عزمت حقاً أن تترك الدخان فابدأ من الآن، ألقِ الدخينة من يدك ولا تؤجل تركه دقيقة واحدة، لأن الدقيقة تجر دقيقة والساعة تجر ساعة فلا تتركه أبداً.

ويا أيها التلميذ الذي يريد أن يستعد للامتحان! ابدأ من الآن، ولا تقل سأبدأ غداً، لأن الغد إذا جاء صار حاضراً وأعقبه غد جديد، فلا ترى إلا الامتحان قد صار أمامك وأنت لم تصنع شيئاً.

ويا أيتها المرأة التي تريد أن تصلح نفسها، وتضع عقلها في رأسها فتهتم بأمر زوجها وأولادها لا بالأزياء والاستقبالات وبالكلام الفارغ! اشرعي من الآن.

ويا من يعلم أن بعد الدنيا آخرة، وأن بعد الحياة موتاً، وأن لا بد من وقفة للحساب ومشية على الصراط وليس -بعدُ- إلا الجنة أو النار! تب من الآن ولا تؤجل التوبة إلى غد، فإنك لا تدري ما هو مقدَّر عليك في غد.

وليكتب كل واحد منكم هذه الحكمة في لوحة كبيرة: «لا تؤجل عمل اليوم إلى غد»، وليعلقها في صدر مجلسه، ولينظر فيها صباحه ومساءه، وليعمل بها، فهي دستور النجاح وأساس الفلاح-

«لا تؤجل عمل اليوم إلى غد».

المصدر: مع الناس بقلم الشيخ علي الطنطاوي