আমাদের ছোটরা আমাদের আমানত
গত কয়েকদিন আগে অন্তর্জালে একটি ঘটনা পড়লাম। শায়খ মুহাম্মাদ আল–আরিফীর ঘটনা। তিনি নিজেই বর্ণনা করেন –
আমি একবার এক মাদরাসায় ছোট ছোট তালিবে ইলমদের এক মজলিসে নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে বয়ান করছিলাম। তাদেরকে বললাম- নামায সম্পর্কে একটি হাদীস বলো দেখি। তখন একজন উত্তর দিল- بين الرجل و بين الكفر أو الشرك ترك الصلاة
তার উত্তরটি আমার এত ভাল লাগল যে, সাথে সাথে আমার হাতের ঘড়িটা খুলে তাকে দিয়ে দিলাম। সাধারণ একটি ঘড়ি ছিল, সব সময় ব্যবহার করার জন্য কিনেছিলাম। কিন্তু কে জানতো যে, এই সাধারণ সস্তা একটি ঘড়ি ছোট্ট এই ছেলেটির জীবনে অসাধারণ ও স্থায়ী একটি ছাপ ফেলবে!
এই ঘটনার বেশ অনেকদিন পরের কথা, আসলে কয়েক বছর কেটে গেছে। একবার এক মসজিদে ছিলাম। মসজিদের ইমাম হলো এক নওজোয়ান আলেম। ইসলামী শরীয়ত কলেজ থেকে পাশ করে এখন এক আদালতের বিচারকের দায়িত্বে রয়েছে। পাশাপাশি এই মসজিদের দায়িত্বও পালন করছে। কিন্তু আমি তখনও জানি না কি বিপুল বিস্ময় অপেক্ষা করছে আমার জন্য । ঐ নওজোয়ান আলেম তখন আমার সেই হাত ঘড়ির ঘটনা বর্ণনা করল, যেটা আমি কয়েক বছর আগে এক ছোট্ট তালিবে ইলমকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলাম। আর আমার সামনে বসা এই নওজোয়ান আলেমই হলো সেদিনের সেই ছোট্ট তালিবে ইলম।
শায়খ আরিফী তার হাত ঘড়িটি খুলে বাচ্চাটিকে দিয়ে দেন, তারপর পৃথিবীর চাকা ঘুরে বেশ অনেক সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। কিন্তু সেই বাচ্চাটির জন্য সময়ের চাকা সেই ঘড়ির কাঁটাতেই আটকে যায়। একটি মাত্র ঘড়ি। এমন কিইবা তার মূল্য! কিন্তু তার হাতে এটি যেন পুরো পৃথিবী জয় করার শক্তি ও সাহস এনে দেয়। পৃথিবীর বুকে এক অপার্থিব গুলিস্তাঁর চাবি কাঠি পেয়ে যায়। কোরআন-সুন্নাহর ঐশী বাগানের সদর-দরজা তার সামনে উন্মোক্ত হয়ে যায়।
******
শিশু-কিশোরদের মনোজগত যেমন খুবই ছোট্ট হয়ে থাকে, তেমনি তাদের অনুভূতিগুলোও হয় খুবই সংবেদনশীল। স্নেহভরা একটুখানি প্রশংসা, ভালবাসার আলত একটু শাসন তাদের মনোজগতে আবেগ-উচ্ছ্বাসের এমন বিপুল জলোচ্ছ্বাস তৈরী করে, যা ভবিষ্যত জীবনের প্রলয়ঙ্কারী ঝড়ের মোকাবেলা করতে তাদের সক্ষম করে তোলে।
আর যদি এ বয়সে তাদের মন ভেঙে যায় অথবা স্থবির হয়ে যায়, তাহলে ভবিষ্যতের জীবন-ঝড়ের সামনা করার কথা কল্পনা করতেও তারা ভয় পায়।
প্রতিটি শিশুরই রয়েছে একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট ও গুণ। বড়দের এবং অভিভাবকদের উচিত সেই বিশেষ গুণ ও বৈশিষ্টকে খুঁজে বের করে তা চিহ্নিত করা; অতঃপর তাকে এ বিষয়ে সার্বিক সহযোগীতা করা এবং উৎসাহ প্রদান করা। শিশু-কিশোরদের শরীর-স্বাস্থ্যের মত তাদের মনোজগতের জন্যও আলাদা ও ভিন্ন নজরদারি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কারণ শরীরের চেয়ে তাদের মনোজগত হয়ে থাকে অধিক কোমল ও সংবেদনশীল, খুবই সরল অথচ দূরহ ও জটিল। তাই আমরা যদি আমাদের ছোটদেরকে অন্যান্য সহযোগীতার পাশাপাশি মানসিকভাবেও সহযোগীতা করি; তাদের প্রতিভাগুলোর সঠিক মূল্যায়ন করি আর তাদের ভুলগুলোসহই তাদের ভালবাসি, তাহলে ইনশাআল্লাহ এই ভালবাসার দাবি তারা রক্ষাকরবে।
******
এ ক্ষেত্রে সবচে’ অসহায় হলো আমাদের কওমী মাদরাসার শিশু এবং কিশোররা। বিশেষ করে কিশোররা। কারণ শিশুদের বেশির ভাগই একসাথে থাকার কারণে খেলা ও পড়ালেখায় মত্ত থাকে। কিন্তু কিশোর বয়সী যারা আছে, তারা এক সাথে থাকা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে একা হয়ে যায়। কারণ ততদিনে জীবনের সাধারণজ্ঞানের প্রথম পাঠ তাদের সামনে চলে আসে। কিন্তু জীবনের এই অজানা অধ্যায় সম্পর্কে তাদের কোন রাহনুমা থাকে না। পড়ালেখাসহ আরো আনুষঙ্গিক যেসব কাজকর্ম আছে, সেগুলো শেষ করার পরও তারা অবসর থাকে। অনেক সঙ্গী-সাথীর মাঝে থেকেও তাদের কেউ কেউ হয়ে যায় নিঃসঙ্গ। এ সময়টিতে তারা পৃথিবীকে নতুন দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে। পৃথিবী নামের এই অদ্ভুত গ্রহটির রংধনু তখন তাদের মনের আকাশে নতুন নতুন রং নিয়ে ভেসে ওঠে। তখন তারা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে অস্থির হয়ে ছটফট করে। কোন রঙটি দিয়ে তারা তাদের জীবনের শব্দছবি আঁকবে-এই প্রশ্ন তখন অসংখ্য অজানা আঘাত হয়ে তাদের মনোজগতকে জর্জরিত করে।
যে সকল ধ্বনিবা ধ্বনিসমষ্টি দ্বারা মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করে তাকে ভাষা বলে। কিন্তু এ বয়েসী কিশোররা তাদের জীবনে এমন কিছু মুহূর্তের সম্মুখিন হয়, যে মুহূর্তে সারা জীবনের ধ্বনি ও ধ্বনিসমষ্টি মনের সে ভাব প্রকাশে ব্যর্থ হয়। সে মুহূর্তটি যদি হয় সুখ ও আনন্দের, তাহলে তার ঠোঁটের কোনে ভেসে ওঠে এক টুকরো দুর্লভ হাসি। কিন্তু তা যদি হয় দুঃখ ও বেদনার, তাহলে অজান্তেই তার দু’চোখ ভরে ওঠে হৃদয় নিংড়ানো নোনা আঁসুতে।
দুঃখ ও বেদনার এ ভাষাহীন মুহূর্তে তারা জীবনের প্রতি ক্লান্তি বোধ করে। একটু বিশ্রাম নিতে চায়। ক্লান্ত মুসাফির যেমন বিশ্রামের জন্য এক টুকরো ছায়ার খোঁজ করে, এরাও তেমনি একটু শান্তি ও সান্ত্বনার জন্য একটি ছায়ার খোঁজ করে .. মানব ছায়ার। তারা তখন এমন একটি ছায়ার খোঁজ করে, যে তাদের একটু সান্ত্বনা দেবে, দুটি আশার কথা শোনাবে .. জীবন শব্দের অর্থ শেখাবে। এ সময়টিতে যদি কোন মানবছায়ার শীতল স্পর্শ সে লাভ করে, তাহলে তার যিন্দেগীর রাহে মনযিলে হাজারো বিষাক্ত কাঁটা সে তার রক্তমাখা চরণ-তলে একলা দলে এগিয়ে চলে সম্মুখপানে। আর যদি জীবন সফরের এই অজানা পথে কোন ছায়ামানবের দেখা সে না পায়, তখন মনযিল ভেবে মরিচিকার পেছনে ছুটতে থাকে। যা এক সময় তাকে ব্যর্থতার এমন এক চোরাবালিতে নিয়ে ফেলে, জীবনের সবটুকু আবে-হায়াত যাতে একটু একটু করে শেষ হয়েই যায়.. إلا ما شاء الله.. و قليل ما هم ...
তাই আজ যারা আমাদের ছোট, তাদেরকে বুকে টেনে নিতে হবে তাদের ভুলগুলোসহই। আমরা যদি তাদের জিজ্ঞেস করি ‘কী হয়েছে?’ আর তারা যদি অন্যদিকে তাকিয়ে বলে ‘..কিছু না’ তাহলে আমরা তাদেরকে আমাদের দিকে ফিরাবো। হৃদয়ের একমাত্র প্রতিচ্ছবি তাদের চোখগুলোর দিকে তাকাব। তারপর বলবো- ‘কি হয়েছে খুলে বলো, কোন সমস্যা নেই।’ তাদের প্রতিটি ভাল কাজের মূল্যায়ন করতে হবে এবং তাদের মাঝে এই বিশ্বাস সৃষ্টি করতে হবে যে, আমরা তাদেরকে বিশ্বাস করি। তাদের প্রতি আমাদের আস্থা রয়েছে। তাদের প্রতি আমাদের মমতা রয়েছে। তবেই তারা নিজেদের প্রতি আস্থা রাখতে শিখবে। নিজেদের আত্মার আস্তিত্বের মূল্যায়ণ করতে শিখবে।
আসুন আজ আমরা আমাদের ছোটদের নতুন করে ভালবাসি। আমাদের সন্তানদের নতুন করে বুকে টেনে নিই। তারা যদি কোন অন্যায় করে, কোন ভুলের কারণে যদি বিপদে পড়ে, তাহলে নিজেদের যেন তারা অসহায় একা না ভাবে। তারা যেন আমাদের বুকে তাদের সবচে’ নিরাপদ আশ্রয়টুকু খুঁজে পায়। যত যা কিছুই হোক, তারা যেন আমাদের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে জীবনের সব দুঃখ-হতাশার যন্ত্রনাগুলো অশ্রুজলে ধুয়ে নিতে পারে।
আজ যদি আমরা আমাদের ছোটদেরকে তাদের ভুলগুলোসহ ভালবাসতে পারি, তাহলে আমাদের ভালবাসার দাবিতে তারা তাদের ভুলগুলো মিটিয়ে দেবে। তারপর যখন তারা সত্যিকার অর্থে প্রাপ্তবয়ষ্ক হবে .. পৃথিবীর অর্থহীন রংধনু থেকে যখন সাদা আর কালোকে আলাদা করতে শিখবে .. যখন তারা জীবনের সাথে জীবনের ভাষায় কথা বলতে শিখবে.. জীবন যখন তাদের ভালবাসতে শেখাবে .. জীবনকে যখন তারা ভালবাসতে শিখবে .. যখন তারা আকাশের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাবে এবং বুঝবে- তাদের উপরের ভালবাসার ছায়াটি ঐ উপরের আকাশ-মহাকাশ থেকেও বড়, তখন তারা সেই ছায়াদার মানব-বৃক্ষটির দিকে তাকাবে নতুন করে। নতুন করে ভালবাসবে জীবনের সেই ছায়ামানবটিকে। তবে এইবার .. এইবার ভালবাসার সাথে শামিল হবে শ্রদ্ধা। শরীরের প্রতিপি রোমকূপ তখন তাকে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানাবে হৃদয়ের গহীন থেকে।
আর ভালবাসার সৌরভে যে শ্রদ্ধা সুরভিত, তা হৃদয়কে মন্থন করে আসে। বয়সের কারণে মানুষ যে শ্রদ্ধা পায় সেটা ফ্রী। এটা ব্যাস প্রকৃতির নীতিগত একটি করুণা মাত্র। কিন্তু ভালবাসার শ্রদ্ধা এমনি এমনি পাওয়া যায় না। সেটা অর্জন করতে হয় নিজ গুণে।
বিষয়বস্তু:প্রবন্ধ সমসাময়িক সামাজিক জীবন সমালোচনা আত্মসমালোচনা বিশ্লেষণ