১৯৬৯ সালের একটি ফতোয়া এবং আজকের আমরা
১| মাদরাসায় আমার হুজুরের কাছে প্রচুর আরবী ম্যাগাজিন পেয়েছিলাম। এই ম্যাগাজিনগুলো খুব পড়তাম। সবগুলো না, যেগুলো ভাল লাগতো সেগুলো। বেশিরভাগ সময়ই শুধু সাহিত্যপাতাটা পড়তাম। অসাধারণ সব গল্প আর প্রবন্ধ থাকতো সেগুলোতে। এই ম্যাগাজিনগুলোর মধ্যে একটা ছিল 'আল-ওয়া'য়ুল ইসলামী' (الـوَعْـيُ الْإِسْـلاَمِـيُّ)। এটি কুয়েতের ধর্মমন্ত্রনালয় থেকে প্রকাশিত হয়। ১৯৬৫ সালের মে মাস থেকে এটি নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে।
২| শায়খ আবদুল্লাহ বিন বায রহ.। নিকট অতীতে ইসলামী বিশ্বের এক মহাবিস্ময়। ১৯৯৩ সাল থেকে সৌদির প্রধান মুফতী হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ "ফাতহুল বারী" কিতাবের মূল্যবান টীকাসহ বহু গ্রন্থ লিখেছেন, যেগুলোর লিস্ট এখানে দিচ্ছি না। তার ব্যাপারে আরবীতে সবচে' বেশি তথ্য পাবেন। তবে ইংরেজীতে এক নজর দিতে পারেন উইকিপিডিয়ার এই পেজে। শায়খ বিন বাযকে নিয়ে তৈরি হয়েছে ওয়েবসাইট- তার লিখিত কিতাবাদি, বিভিন্ন বক্তৃতা, প্রবন্ধ, কলাম, ফতোয়াসহ শায়খের জীবনের প্রায় সকল কীর্তিই সেখানে সংকলন করার চেষ্টা করা হয়েছে। ঐ সাইটটি পাবেন এখানে... আর সাইটটির ফেসবুক পেজ হচ্ছে এটি।
বিশুদ্ধ ইসলামী আকীদার অনুসারী আলেমদের নিকট তিনি হচ্ছেন রাহবার বা পথ-প্রদর্শনকারী। তিনি যদি কোন ফতোয়া দেন, তাহলে সেই ফতোয়ার দলীলের ভিত্তি কেমন শক্তিশালী হবে, সেটা অনুমান করার জন্যই তার ব্যাপারে এই অতি সংক্ষিপ্ত ভূমিকা টানলাম। ভূমিকা শেষ, এবার মূল আলোচনায় যাওয়া যাক।
মূল আলোচনা
উপরে কুয়েতের যে আরবী ম্যাগাজিনটির কথা বললাম- 'আল-ওয়া'য়ুল ইসলামী', শায়খ বিন বায এই ম্যাগাজিনটিতে লিখতেন। কর্তৃপক্ষ এই ম্যাগাজিনে প্রকাশিত শায়খের সবগুলো প্রবন্ধের একটি সংকলন প্রকাশ করে। প্রথম প্রকাশ কত সালে সেটা জানি না, তবে ২০১০ সালে এর ২৩তম সংস্করণ প্রকাশ করা হয়। ২৩তম সংস্করণের সরাসরি পিডিএফ ফাইলটি পেতে হলে এখানে ক্লিক করতে হবে।
কিতাবটির সর্বপ্রথম প্রবন্ধের শিরোনাম হলো (অনুবাদ)- "নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে মিথ্যে স্বপ্ন"। শায়খ বিন বায এই প্রবন্ধে যা লিখেছেন তার সারমর্ম নিম্নরূপ-
আমি একটি লিফলেটের ব্যাপারে জানতে পারলাম যা সৌদির বিভিন্ন প্রদেশে প্রচার করা হচ্ছে। এই লিফলেটে বলা হচ্ছে যে, হাজ্বী আবদুল লতীফ নামের এক ব্যক্তি মক্কায় রসূল সা.-কে স্বপ্নে দেখেছে, রাসূল তাকে পৃথিবীর সমস্ত মুসলমানদের প্রতি ঈমান ও পারস্পরিক সহয়োগীতার ব্যাপারে নসীহত করেছেন। এই কাগজে আরো বলা হচ্ছে যে, যে ব্যক্তি এটি পড়বে, তার উপর ওয়াজিব হলো আরও আটবার এই কাগজের বক্তব্য লেখা এবং তা প্রচার করা। যে ব্যক্তি তা করবে না, সে ভয়াবহ কোন রোগে আক্রান্ত হবে। আর যে করবে, দশ দিনের মধ্যে সে বিরাট সুসংবাদপ্রাপ্ত হবে।
এইটুকু লেখার পর শায়খ খুব কঠোর ভাষার এই ভিত্তিহীন বিষয়টির নিন্দা করেন। তারপর এটি কেন ভিত্তিহীন সেটি বলতে গিয়ে বলেন-
ওলামায়ে কেরামের 'এজমা' বা ঐক্যমত এই বিষয়ে যে, মানুষ যদি কোরআন ও হাদীস লিপিবদ্ধ না করতো, তাহলেও কোন সমস্যা ছিল না। কোরআন ও হাদিস হলো সর্বোত্তম কালাম, যেখানে কোরআন ও হাদীস সম্পর্কেই এমনটি বলা হচ্ছে, সেখানে এই ধরণের কাগজের বক্তব্য যে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন সেটা যে কোন সুস্থ্য মানুষই বুঝতে পারে। তাই কেউ যদি এই ধরণের কোন কাগজ পায়, তাহলে তার উচিৎ হলো সেটাকে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলা এবং মানুষকে এ বিষয়ে সতর্ক করা।
শায়খ বিন বায রাহ.-এর এই ফতোয়াটি উল্লেখিত ম্যাগাজিনটির ৫৬তম সংখ্যায় ছাপা হয়, এই সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালের অক্টোবর মাসে।
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা! চিন্তা করুন, ১৯৬৯ সালে শায়খ বিন বায রহ. -এর মত ব্যক্তিত্ব ফতোয়া দিয়েছেন এ ধরণের কাগজ পেলে যেন টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলা হয় এবং অন্য মুসলমানকে এ ব্যাপারে সতর্ক করা হয়। অথচ এই ২০১৬ সালেও আমাদের দেশের মসজিদে বাইরে এ ধরণের কাগজ বিলি করা হয়, আর আমাদের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যা এই কাগজের কথার উপর আমলও করে।
এখন যে ধরণের কাগজগুলো বিলি করা হয়, সেগুলো একটু আপডেট। যেমন আগে এগুলোতে বলা হতো যেন হাতে আরও আটবার লিখে অন্যকে দেয়, আর এখনকারগুলোতে বলে ফটোকপি করে বিলি করতে। না করলে এই হবে সেই হবে।
ঠিক এই ধরণের ফালতু কাগজের মতই অনেকটা ফেসবুকের বিভিন্ন "রেডিও পেজ" থেকে বিভিন্ন পোস্ট শেয়ার দেয়া হয়, সাথে একটি প্রচণ্ড বিরক্তিকর কথা লিখে দেয়া হয়- "মুসলমান হলে লাইক না দিয়ে যাবেন না", "মুসলমান হলে শেয়ার না করে যাবেন না" এবং "মুসলমান হলে কমেন্টে 'আমীন' না লিখে যাবেন না"। আজব তো! মুসলমান হয়ে যদি আমি লাইক না দেই, তাহলে কি আমার মুসলমানিত্ব ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে চারদিকে ছড়ায় পড়বে? এ ধরণের পোস্টকে গুরুত্ব দেয়ার কোন মানেই নাই। ইসলাম সম্পর্কে যাদের জেনারেল নলেজ ভাল, তারা এগুলো দেখলেই বুঝতে পারে। কিন্তু যারা সাধারণ মুসলমান, তারা দ্বিধায় পড়ে যায়। ইচ্ছা না থাকলেও লাইক দিয়ে দেয়। অনেকে আবার নিজের উৎসাহ থেকেই লাইক দেয়, শেয়ার করে এবং আরো যা কিছু করা যায় করে। সবচে' ভয়ের বিষয় হলো, এই ধরণের পেজ থেকে প্রায়ই বিভিন্ন হাদীস পোস্ট করা হয়, আর এই হাদীসগুলোর মধ্যে এমন অনেক হাদীস আছে যেগুলো পরিপূর্ণ জাল। কতগুলো এমনও আছে যে, হাদীস না, বরং আরবী প্রবাদ। অথচ হাদীস বলে পোস্ট করা হচ্ছে। আর জাগ্রত জনতাও সাথে সাথে লাইক-শেয়ারের বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছে এসব পোস্ট।
আপনি যদি সত্যিই হাদীস জানতে চান, তাহলে হাদীসের গ্রন্থ থেকে জানুন। যদি অনলাইন থেকে হাদীস সম্পর্কে জানতে চান, তাহলে ইসলামী ওয়েবসাইটগুলো ভিযিট করুন। আল-কাউসার আছে, ইসলামিক কোশ্চেন আছে, আওয়ার ইসলামসহ অারো অনেক ইসলামী সাইট আছে। এই সব সাইটের কন্ট্যান্ট শেয়ার করুন, এই সব সাইটের যে ফেসবুক পেজ আছে, সেগুলোর সাথে সম্পৃক্ত থাকুন। এই সাইটগুলো থেকে আপনি ইসলাম সম্পর্কে আপনি বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্জন করতে পারবেন। জ্ঞান অর্জন করার জন্য যেখানে চীনে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেখানে আমরা ফেসবুকে ফালতু সব পোস্ট লাইক শেয়ার করে ভাসায় দিচ্ছি সবকিছু। সচেতন হন, জীবনের অন্যান্য অঙ্গনে আমরা খুব সচেতন, কিন্তু ইসলামী জ্ঞানের ক্ষেত্রে এখনও আমাদের সাধারণ মুসলমানরা লজ্জাজনকভাবে অনেক পিছিয়ে। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আপনাকে, আমাকে এবং আমাদের সবাইকে। আল্লাহ সবাইকে তাওফীক দান করুন। আমীন।
সকল বন্ধুদের নিকট বিনীত অনুরোধ, আপনারা এই নোটের বক্তব্যকে ছড়িয়ে দিন, যে যেভাবে পারেন, এই বক্তব্যগুলো ছড়িয়ে দিন। সরাসরি নিজের টাইম লাইনে কপিপেস্ট করতে পারেন, সরাসরি নিজের টাইমলাইনে শেয়ার করতে পারেন। অথবা এই নোটের লেখাগুলো নিজের মত করে সাজিয়ে নিজের টাইমলাইনে পোস্ট করতে পারেন। অফলাইনে কারো সাথে ফেসবুক নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এ বিষয়টি তুলে ধরতে পারেন। আর লেখার স্বত্ব উল্লেখ করা জরুরী না, তবে দলীলগুলো উল্লেখ করা জরুরী।
অন্যান্য সূত্রসমূহ:
- ইংরেজিতে শায়খ বিন বায রাহ. -এর উইকি পেজ।
- শায়খ বিন বায রহ.-কে নিয়ে করা ওয়েবসাইট এবং এই সাইটের ফেসবুক পেজ।
- যে কিতাবটিতে শায়খ বিন বায রাহ. -এর মূল প্রবন্ধটি আছে, সেই কিতাটির সরাসরি পিডিএফ লিঙ্ক।
- উল্লেখিত আরবী ম্যাগাজিনটির ওয়েবসাইট।
উল্লেখ্য কিতাবের আলোচ্য প্রবন্ধটির স্ক্রিনশট
বিষয়বস্তু:প্রবন্ধ সমসাময়িক সামাজিক জীবন সমালোচনা আত্মসমালোচনা বিশ্লেষণ ফিতনা কুসংস্কার গুজব প্রচলিত ভুল