আল্লাহ পরম প্রিয়তম মোর
আল্লা পরম প্রিয়তম মোর, আল্লা তো দূরে নয়,
নিত্য আমারে জড়াইয়া থাকে পরম সে প্রেমময়!
পূর্ণ পরম সুন্দর সেই আমার পরম পতি,
মোর ধ্যান-জ্ঞান তনু-মন-প্রাণ, আমার পরম গতি।
প্রভু বলি কভু প্রণত হইয়া ধূলায় লুটায়ে পড়ি,
কভূ স্বামী বলে কেঁদে প্রেমে গলে তাঁরে চুম্বন করি!
তাঁর উদ্দেশে চুম্বন যায় নিরুদ্দেশের পথে,
কাঁদে মোর বুকে ফিরে এসে যেন সাত আসমান হতে।
তারি সাধ পুরাইতে বলি, ‘আমি তাহার নিত্যদাস।’
দাস হয়ে করি তাঁর সাথে কত হাস্য ও পরিহাস।
রূপ আছে কি না জানি না, কেবল মধুর পরশ পাই,
এই দুই আঁখি দিয়া সে অরূপে কেমনে দেখিতে চাই!
অন্ধ বধূ কি বুঝিতে পারে না পতির সোহাগ তার?
দেখিব তাহার স্বরূপ, কাটিলে আঁখির অন্ধকার!
__________কেমনে বলিব ভয় করি কি না তাঁরে,
যাঁহার বিপুল সৃষ্টির সীমা আজিও জ্ঞানের পারে।
দিনে ভয় লাগে, গভীর নিশীতে চলে যায় সব ভয়,
কোন সে রসের বাসরে লইয়া কত কী যে কথা কয়!
কিছু বুঝি তার, কিছু বুঝি না ক, শুধু কাঁদি আর কাঁদি;
কথা ভুলে যাই, শুধু সাধ যায় বুকে লয়ে তারে বাধিঁ!
সে প্রেম কোথায় পাওয়া যায় তাহা আমি কি বলিতে পারি?
চাতকী কি জানে কোথা হতে আসে তৃষ্ণার মেঘ-বারি?
কোন প্রেমিকা ও প্রেয়সীর প্রেমে নাই সে প্রেমের স্বাদ,
সে প্রেমের স্বাদ জানে একা মোর আল্লার আহলাদ!
তাঁরে নিয়ে খেলি, কভু মোরে ফেলি যেন দূরে চলে যায়,
সাজানো বাসর ভাঙি অভিমানে ফেলে দি’ পথ-ধুলায়!
বিরহের নদী ফোঁপাইয়া ওঠে বিপুল বন্যা-বেগে,
দিন গুণে কত দিন যায় হায়, কত নিশি যায় জেগে!
চমকিয়া হেরি কখনো অশ্রু-ধৌত বক্ষে মম,
হাসিতেছে মোর দিনের বন্ধু, নিশীথের প্রিয়তম!
আমি কেঁদে বলি, ‘তুমি কত বড়, কত সে মহিমাময়,
মোর কাছে আস, শাস্ত্রবিদেরা যদি কলঙ্কী কয়!
নিত্য পরম পবিত্র তুমি, চির প্রিয়তম বঁধূ,
কেন কালি মাখ পবিত্র নামে, মোরে দিয়ে এত মধু!
মোরে ভালবাস বলে তব নামে এত কলঙ্ক রটে,
পথে ঘাটে লোকে কয়, যাহা রটে, কিছু ত সত্য বটে!’
তুমি বল, ‘মোর প্রেমের পরশ-মানিক পরশে যারে,
আর তারে কেউ চিনিতে পারে না, সোনা বলে ডাকে তারে।
তাহার অতীত, তাহার স্বধর্ম মুহূর্তে মুছে যায়,
তবু নিন্দুক হিংসায় জ্বলে নিন্দা করে তাহায়!’
‘সে কি কাঁদে’, কহে শাস্ত্রবিদেরা। মোর প্রেম বলে, ‘জানি,
আমার চক্ষে বক্ষে দেখেছি না-দেখা চোখের পানি।
তাঁর রোদনের বাণী শুনিয়াছি বিরহ মেঘলা রাতে,
ঝড় উঠিয়াছে আকাশে তাঁহার প্রেমিকের বেদনাতে।’
আমি বলি, ‘এত কৃপাময়, এত ক্ষমা-সুন্দর তুমি,
মানুষের বুকে কেন তবে এই অভাবের মরুভূমি?’
প্রভুজি বলেন, ‘মোর সাথে ভাব করিতে চাহে না কেউ,
‘আড়ি’ করে আছে মোর সাথে, তাই এত অভাবের ঢেউ।
ভিখারীর মত নিত্য ওদের দুয়ারে দাড়ায়ে থাকি
‘আমারে বাহিরে রেখো না’ বলিয়া কত কেঁদে কেঁদে ডাকি!
আমারে তাহারা ভাবে, আমি অতি ভয়াল ভয়ঙ্কর;
আমি উহাদের ঘর দিই, হায়, আমারে দেয় না ঘর!
আমার চেয়ে কি পরমাত্মীয় মানুষের কেহ আছে!
আমি কাঁদি, হায়, পর ভেবে মোরে ডাকে না তাদের কাছে।
ভয় করে মোরে হইয়াছে ভীরু, যে চায় যা তারে দিই,
জড়ায়ে ধরিতে চায় যে আমারে, তারে বুকে তুলে নিই।
সব মালিন্য, সব অভিশাপ, সব পাপ তাপ তার
আমার পরশে ধুয়ে যায়, আর করি না তার বিচার।
প্রতি জীব হতে পারে মোর প্রিয়, শুধু মোরে যদি চায়,
আমারে পাইলে এই নর-নারী চির পূর্ণতা পায়।’
হেরিনু-চন্দ্র-কিরণে তাঁহার স্নিগ্ধ মমতা ঝরে,
তাঁহারি প্রগাঢ় প্রেম-প্রীতি আছে ফিরোজা আকাশ ভরে।
তাঁহারি প্রেমের আবছায়া এই ধরণীর ভালবাসা,
তাঁহারি পরম মায়া যে জাগায় তাঁহারে পাওয়ার আশা।
নিত্য মধুর সুন্দর সে যে নিত্য ভিক্ষা চায়,
তাঁহারি মতন সুন্দর যেন করি মোরা আপনায়।
অসুন্দরের ছায়া পড়ে তাঁর সুন্দর সৃষ্টিতে,
তাই তাঁর সাথে মিলন হলো না কভু শুভ-দৃষ্টিতে।
আমরা কর্ম্ম করি আমাদের স্বকল্যানের লাগি,
তিনি যে কর্ম্মে নিয়োগ করেন, সেথা হতে ভয়ে ভাগি!
মোরা অজ্ঞান, তাই তিনি চান, তাঁরি নির্দেশে চলি;
তাঁহার আদেশ তাঁরি পবিত্র গ্রন্থে গেছেন বলি।
সে কথা শুনি না, পথ চলি মোরা আপন অহঙ্কারে,
তাই এত দুখ পাই, এত মার খাই মোরা সংসারে।
চলে না তাঁহার সুনির্দিষ্ট নির্ভয় পথে যারা,
অন্ধকারের গহ্বরে পড়ে মার খেয়ে মরে তারা।
তাঁর সাথে যোগ নাই যার, সেই করে নিতি অভিযোগ;
তাঁর দেয়া অমৃত ত্যাগ করে বিষ করে তারা ভোগ।
ভিক্ষা করিয়া তাঁর কৃপা কেউ ফেরেনি শূন্য হাতে,
যারা চাহে নাই, তারাই তাঁহারে নিন্দে অবজ্ঞাতে।
কার করুণায় পৃথিবীতে এত ফসল ও ফুল হাসে,
বর্ষার মেঘে নদ-নদী-স্রোতে কার কৃপা নেমে আসে?
কার শক্তিতে জ্ঞান পায় এত; পায় যশ সম্মান,
এ জীবন পেল কোথা হতে, তার আজিও পেল না জ্ঞান।
তাঁরি নাম লয়ে বলি, ‘বিশ্বের অবিশ্বাসীরা শোন,
তাঁর সাথে ভাব হয় যার, তার অভাব থাকে না কোন।’
তাঁহারি কৃপায় তাঁরে ভালবেসো বলে আমি চলে যাই,
তাঁরে যে পেয়েছে, দুনিয়ায় তার কোন চাওয়া-পাওয়া নাই।
আর বলিব না। তাঁরে ভালবেসে ফিরে এসে মোরে বলো, কি হারাইয়া কি পাইয়াছ তুমি, কি দশা তোমার হলো!
কবিতাটি নজরুল ইসলাম ইসলামী কবিতা বই থেকে সংগৃহিত